ঐ মহামানব আসে...
তোফায়েল আহমেদ
আওয়ামী লীগ নেতা। মন্ত্রী, শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে এক অনন্য ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২-এর এই দিনটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন করেছিল। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হলেও বাংলার মানুষ বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ পায়নি। দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠের নারকীয় বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ৮ জানুয়ারি পিআইএ'র একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছেন। পরদিন অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি, লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি একটি বিবৃতি প্রদান করেন। 'জয় বাংলা' রণধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, 'বাংলার মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দী জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য অনুরোধ জানাবে।' পরিশেষে তিনি বলেন, 'আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।' তিনি জনগণের কাছে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘ সময়ের বন্দী জীবনের নিঃসঙ্গতা তাকে কাবু করতে পারেনি। জনগণের আরাধ্য প্রিয় নেতা তার মানস জগতে জনতার সাহচর্য লালন করেছেন প্রতিনিয়তই।
মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ট্রেনিং সমাপ্ত করে শপথ গ্রহণ করতাম এই বলে যে, 'বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ, আমরা জানি না। কিন্তু যতক্ষণ তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে আমরা হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।' ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় দেশ শত্রুমুক্ত হলেও বিজয় তখনো পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। ইতিহাসের সেই মহামানব বাঙালি জাতির জনক তখনো ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। যেদিন ৮ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংবাদ জানলাম সেদিন এক অনির্বচনীয় আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল সারা দেশে। মানুষের যে কি আনন্দ তা ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। দেশবাসী অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে কখন প্রিয় নেতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন। অবশেষে পরমাকাঙ্ক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি এলো। সে দিনটি ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ 'জয় বাংলা', 'জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে যাচ্ছে। কোটি কোটি হৃদয় রুদ্ধবাক মুহূর্ত গুনছে, প্রতি নিঃশ্বাসে অধীর আগ্রহে কালক্ষেপণ করছে, কখন, কখন আসবেন প্রিয় নেতা? কি দিয়ে তারা বরণ করে নেবে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে, বাঙালির হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ গর্বকে। রণক্লান্ত যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধা, শ্রদ্ধাবনতচিত্তে সংগ্রামী জনতা, অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে সন্তানহারা জননী, স্বামীহারা পত্নী, পিতৃহারা পুত্র-কন্যা সব দুঃখকে জয় করে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা ভুলে গর্বোদ্ধত মস্তকে সবাই অধীর আগ্রহে আজ অপেক্ষমাণ দুই হাত বাড়িয়ে জাতির জনককে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করার জন্য।
ঢাকায় যখন এমন সাজ সাজ রব। তখন সকাল থেকেই দিল্লির রাজপথ ধরেও হাজার হাজার মানুষের মিছিল পালাম বিমানবন্দর ও প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দিলি্লর জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তার সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর আগেই উপস্থিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, 'আপনার জন্য আমি গর্বিত। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য গর্ব অনুভব করে। শেখ মুজিবকে আমাদের মাঝে পেয়ে ভারতের জনগণ আজ আনন্দে আত্দহারা। শেখ মুজিব তার জনগণকে নতুন জীবন দান করেছেন। তার স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ সার্থক। শারীরিকভাবে তিনি বন্দী ছিলেন কিন্তু তার স্বপ্ন ও সাধকে বাস্তবায়িত করতে বাংলার জনগণ তারই অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।' সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভারতবাসীর উদ্দেশে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, 'আমার জন্য এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশে যাওয়ার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী- যিনি কেবল মানুষের নন, মানবতারও নেতা। তার নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার নূ্যনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব। এ অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দীদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়। অবশেষে আমি ৯ মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ ৯ মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল; আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী। আমি ফিরে যাচ্ছি, আমার হৃদয়ে কারও জন্য কোনো বিদ্বেষ নিয়ে নয়, বরং এই পরিতৃপ্তি নিয়ে যে, অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভর বিরুদ্ধে শুভর বিজয় হয়েছে।' অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বঙ্গবন্ধু একান্তে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, 'ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমি ঋণী। আপনি আমার বাংলার মানুষকে অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন; আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে আপনি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আপনার কাছে আমরা চিরঋণী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ। আপনি কবে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবেন।' শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মহানুভবতার স্বরে বলেছিলেন, 'আপনি যেদিন চাইবেন।' বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন, যিনি দেশপ্রেমকে সর্বাগ্রে স্থান দিতেন। এরকম একটি অবস্থার মধ্যেও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যর্পণের বিষয়টি আলাপ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায় করে নেন।
এরপর অবসান ঘটে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশসীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দুপুর ১-৫১ মিনিটে বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতা, আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ছুটে যাই নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমার হাতে ছিল পুষ্পমাল্য। জাতির জনককে মাল্যভূষিত করার সঙ্গে সঙ্গেই তার সংযমের সব বাঁধ ভেঙে যায়, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত। যা আমার মানসপটে এখনো জ্বল জ্বল করে। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তার চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী, আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়বে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তির এ রূপ প্রকাশ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলা মায়ের প্রতিফলিত বিশুদ্ধ প্রতিচ্ছবির এক হিরণ্ময় প্রকাশ। কান্না-হাসির দোলদোলানো সে এক আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। আমরাও অঝোরে কেঁদেছি সেদিন। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। চারদিক থেকে তার ওপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণী ওসমানী, লে. কর্নেল শফিউল্লাহ এবং বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে সে. লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল জাতির জনকের পাশে ছিলেন। মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী গার্ড অব অনার পরিচালনা করেন। গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতা, ঢাকাস্থ বিদেশি মিশনের সদস্য ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে করমর্দন করেন।
এরপর রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে উঠে রওনা দেই। সুদৃশ্য তোরণ, বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের দুই পাশে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যখন ময়দানে পৌঁছলাম তখন বিকাল সাড়ে ৪টা। অর্থাৎ বিমানবন্দর থেকে ময়দান পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। নেতাকে নিয়ে যখন ময়দানে প্রবেশ করি তখন লাখ লাখ প্রতীক্ষমাণ মানুষ, কোনোদিকে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত। 'জয় বাংলা', 'জয় বঙ্গবন্ধু' রণধ্বনিতে সবকিছু যেন ডুবে গেল। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে তাকালেন এবং রুমালে মুখ মুছলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেবলই মনে হয়েছে, জাতির জনক জীবনভর এমন একটি দিনের অপেক্ষায়ই ছিলেন। সবসময় লক্ষ্য করেছি তার মুখাবয়বে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত তা ছিল অকপট। দীর্ঘ কারাবাসের ক্লান্তিতে মলিন মুখটি যেন তবু সমুজ্জ্বল। উন্নত ললাট, প্রশান্ত বদন, দুই চোখ তখনো অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। সে অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে 'ভায়েরা আমার' বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ। হৃদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে আবেগঘন ভাষায় বলেন, 'ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।' আমি তখন ভাবছি দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন নির্জন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গোনা একজন মানুষ কী করে এরকম উদ্বেলিত পরিস্থিতিতেও স্থির-প্রতিজ্ঞ থেকে বলছেন, 'ভায়েরা, তোমাদের একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।' এমন পরিস্থিতিতেও সব কথার মধ্যে তিনি বলেন, 'সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।' এটাও একটি ইঙ্গিতবাহী কথা। বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, 'আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।' ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান স্মরণ করে বেদনা-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, 'আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।' পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেন, 'আমি ফিরে আসার আগে ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন দুই অংশের মধ্যে বাঁধন সামান্য হলেও রাখা যায় কিনা। আমি তখন বলেছিলাম, আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আজ আমি বলতে চাই- ভুট্টো সাহেব, আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সঙ্গে আর না।' ভারতবর্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, 'ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাকে জানাই আমার শ্রদ্ধা। তার রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে দিলি্লতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে।' যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেন, 'গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।' বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, 'আমি বিশ্বের সব মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। জাতিসংঘেরও উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে তার ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ করা।' পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তাকে উদ্দেশ করে বলেন, 'সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।' কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।' সভামঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ১৮ নং বাড়িতে গেলেন। যেখানে পরিবারের সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ির সামনে আর একটি বাড়ি তখন তার জন্য রাখা হয়েছিল। কেননা ধানমন্ডির ৩২ নং বাসভবনটি শত্রুবাহিনী এমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল যে, বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। ১১ জানুয়ারি প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এবং আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করলেন। ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তার রাজনৈতিক সচিব করেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র।
আজ জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মরণীয় এই ঐতিহাসিক দিনটিতে কেবলই মনে পড়ে ৭ মার্চের ভাষণের শেষাংশটি- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' রাজনৈতিক মুক্তি আমাদের অর্জিত হয়েছে। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সংবিধান, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা পেয়েছি। বহু ত্যাগের বিনিময়ে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র পেয়েছি। যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, যুদ্ধ করেছি- কত মা ছেলে হারিয়েছে, বাবা পুত্র হারিয়েছে, বোন স্বামীহারা হয়েছে, রক্তস্নাত সেই বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করতে পারবে, এটা আমরা কখনো ভাবিনি। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছেন। তার সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া ২০০১-এ ক্ষমতাসীন হয়ে যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়ে ৩০ লাখ মানুষের সুমহান আত্দত্যাগ ও ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের সঙ্গে বেইমানি করে স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায়িত করে সমগ্র সমাজকে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেছেন। এই বাংলাদেশ আমরা চাইনি। আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যখন আমরা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আনতে সর্বাত্দক চেষ্টা করেছি, তখন বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী নির্বাচন বানচাল করতে হরতাল-অবরোধের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে মরীয়া। কিন্তু বাংলার মানুষ সব ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে লাখ শহীদের রক্তার্জিত ভোটাধিকার প্রদান করেছে। আজকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে প্রিয় দেশবাসীর কাছে আমার একটাই আহ্বান, যে স্বাধীনতার চেতনা-মূল্যবোধ বুকে ধারণ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আবার সবাই সেই একাত্তরের চেতনা নিয়ে যেন সামনের দিনগুলোতে ঐক্যবদ্ধ হই। যারা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে পাকিস্তানের মতো অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, যারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলি। আর তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন সার্থক হবে।
তথ্য সূত্র- জনাব তোফায়েল আহমেদ এর ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহিত।
ই-মেইল : tofailahmed69@gmail.com