বিশ্বসভায় ৭ই মার্চের বজ্রকণ্ঠ: তোফায়েল আহমেদ

 বিশ্বসভায় ৭ই মার্চের বজ্রকণ্ঠ: তোফায়েল আহমেদ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, যে ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, ভাষণটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আমরা আগে বলতাম বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। আমরা এই ভাষণকে অনেক সময় তুলনা করতাম গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসের আবরাহাম লিঙ্কনের ভাষণের সঙ্গে। কিন্তু জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ২৭ অক্টোবর এ সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে ৩০ অক্টোবর প্যারিসে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তা ঘোষণা করেন। আজ বিশ্ববাসীর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কারণ, এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি সমগ্র জাতিকে জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি।’ তিনি যদি হুকুম দিবার নাও পারেন তাহলে এই ভাষণ জাতির সামনে থাকবে এবং এই ভাষণে তিনি যা উল্লেখ করেছেন সেগুলোই আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। ভাষণে সেই নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন এবং যা একবার বলতেন তার সঙ্গে কখনো আপস করতেন না। এমনকি ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেন কিন্তু সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতেন না। এর বড় প্রমাণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদের হতে হবে। সেই উপলব্ধি থেকে ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি প্রিয় ছাত্রপ্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একটি জাতিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

জাতির জনক ছিলেন দরদি, হৃদয়বান এক মহামানব। বাংলার গরিব-দুঃখী মেহনতি মানুষকে তিনি ভীষণভাবে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের যেখানেই জাতির জনক গিয়েছেন তার সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কাছে থেকে দেখেছি বাংলার মানুষের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। সেই ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। তিনি ছোটকে বড় করে তুলতেন। যেসব জায়গায় সফর করতেন, সেখানকার নেতাদের কর্মকাণ্ডকে আবেগাপ্লুত বক্তৃতার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে বড় করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকে থানা আওয়ামী লীগের নেতা, থানা আওয়ামী লীগের নেতাকে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকে জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত করে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। তার জীবন এবং মৃত্যু একসঙ্গে চলত। জীবন এবং মৃত্যুকে কখনই পরোয়া করেননি। তিনি ছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী। সবসময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কঠিন অবস্থায়ও অবিচল ছিলেন তার সিদ্ধান্তে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড় করিয়েছিল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যেও যখন মানুষ প্রিয় নেতার মুক্তির দাবিতে এক কাতারে, এক মোহনায় দাঁড়িয়েছিল, তখন বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একদিকে ফাঁসির মঞ্চ, আরেকদিকে ছিল প্রধানমন্ত্রীর গদি। তিনি হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চই বেছে নিয়েছিলেন। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না।’ ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী নেতা ছিলেন। শত্রুরা কী করতে পারে সেই খবরটা তিনি সবসময় রাখতেন। ৭ই মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিমান হামলা করে বোমা নিক্ষেপের সমস্ত পরিকল্পনা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী করেছিল। সেদিন আকাশে বোমারু বিমান উড়ছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্য অগ্নিপরীক্ষার দিন ছিল ৭ই মার্চ। কিন্তু এত বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে, সমস্ত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে চারটি শর্ত আরোপ করলেন— মার্শাল ল প্রত্যাহার কর, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নাও, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর কর। এই চারটি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন না। অন্যদিকে পুরো বক্তৃতাটি হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। পাকিস্তানিরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সদাসতর্ক এবং সচেতন। মুক্তিযুদ্ধ আমরা কীভাবে করব, তিনি না থাকলেও তার ভাষণই যেন আমাদের চলার পথের পাথেয় হয়, সেই দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছিলেন। মূলত ৭ই মার্চের বজ্রকণ্ঠই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের চলার পথের পাথেয় ছিল। সে দিনটির সঙ্গে আমি নিজে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রবিবার সকাল থেকেই আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। জাতির পিতার সঙ্গে দুপুর ১২টায় দেখা করি। আমরা ধানমন্ডি থেকে রওনা করি পৌনে ৩টায়। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছাই সোয়া ৩টায়। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা আরম্ভ করেন সাড়ে ৩টায়। ১০ লক্ষাধিক লোকের গগনবিদারী স্লোগানে মুখরিত রেসকোর্স ময়দান। আমি নিজেও স্লোগান দিয়েছি, ‘আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি। এসব স্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম মাইকে ঘোষণা করলাম। সেদিনের সভামঞ্চে জাতীয় চার নেতাসহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন; আমাদের প্রিয় নেতা মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমিসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন, চারদিকে তাকালেন। মাউথপিসের সামনে পোডিয়ামের ওপর চশমাটি রাখলেন। হৃদয়ের গভীরতা থেকে— যা তিনি বিশ্বাস করতেন, যার জন্য তিনি সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন, যার জন্য তিনি ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন, সেই বিশ্বাসী আত্মা দিয়ে— বাংলার মানুষকে তিনি ডাক দিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। তারপর একটানা ১৮ মিনিট বলে গেলেন স্বাধীনতার অমর মহাকাব্য। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করালেন এবং নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিলেন। সেদিনের সেই স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। যখন বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’— সে কী অভূতপূর্ব দৃশ্য, কল্পনা করা যায় না। এটিই মানুষ প্রত্যাশা করেছিল। কি বিচক্ষণ একজন নেতা! আইএসআই ৭ই মার্চ ঢাকা ক্লাবের সামনে ছিল। তারা অপেক্ষা করেছিল— যে ঘোষণাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’— তারা মনে করেছিল সেই কথাটি তিনি ৭ই মার্চ বলবেন। আমি আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু ছিলেন সতর্ক। তিনি সবই বলেছেন, কিন্তু শত্রুর ফাঁদে পা দেননি। উল্টো শত্রুকেই ফাঁদে ফেলেছেন। যার জন্য পরদিন আইএসআই রিপোর্ট করল ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সঙ্গে বক্তৃতা করে গেল। একদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল, আরেকদিকে চারটি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলো না। আমাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।’ এই ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে শুনেছি, ৬ তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু পায়চারী করেছেন এবং ভেবেছেন কী বলবেন! বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘তোমার এত চিন্তার কারণ কী? সারা জীবন তুমি একটি লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তোমার জীবন-যৌবন তুমি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছ, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ, তুমি যা বিশ্বাস কর, সেই বিশ্বাস থেকেই আগামীকাল বক্তৃতা করবে।’

আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে দেরাদুনে যখন ট্রেনিং হয় সেই দেরাদুনসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে বক্তৃতা করেছি। বক্তৃতায় বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আমরা জানি না। কিন্তু প্রিয় নেতা যতক্ষণ বাংলাদেশকে আপনার নির্দেশিত পথে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত করে আমরা বাংলা মাকে স্বাধীন করেছি এবং ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে লন্ডন, দিল্লি হয়ে বাংলার মাটি স্পর্শ করলেন সেদিনই বাংলার মানুষ স্বাধীনতার পূর্ণতা অর্জন করল। জাতির দুর্ভাগ্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিশ্ববিখ্যাত এই ভাষণটি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে ছিল উপেক্ষিত। আমরা যখন কারাগারে বন্দী— ১৯৭৫ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত প্রায় তিন বছরের মতো আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া বিভিন্ন কারাগারে— পত্রপত্রিকায় দেখেছি তখন জাতির পিতার জন্মদিন ১৭ মার্চ, শাহাদাত দিবস ১৫ আগস্ট, একে তো অনুষ্ঠান করতে দিত না, আর দ্বিতীয়ত এই বক্তৃতাটি যাতে মাইকে প্রচারিত না হয় সেজন্য বাধা দেওয়া হতো। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী সেই পঞ্চম জাতীয় সংসদে ’৯৩-এর ৭ মার্চ দাবি তুলে বলেছিলাম, ‘মাননীয় স্পিকার! আপনি জানেন যে, আজকে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। এই দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন— যার ওপর ভিত্তি করে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে আমরা আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। আজকে সেই ৭ই মার্চে বিভিন্ন মহল থেকে আপনি জানেন, এই দিনটিকে পালন করার জন্য আমরা অনুরোধ করেছিলাম। রেডিও, টিভিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি হয়। এমনকি মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেবেরও জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচি হয়ে থাকে, অন্যান্য কর্মসূচি হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নাই, মিস্টার স্পিকার। কিন্তু আজকে ৭ই মার্চের কোনো কর্মসূচি আমাদের টিভি, আমাদের রেডিও কোনো জায়গায় নেই। এটা উপেক্ষিত। এর সঙ্গে সঙ্গে যারা স্বাধীনতাবিরোধী তারা এই সুযোগে স্বাধীনতার ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এই স্বাধীনতার ইতিহাসকে ম্লান করছে। আমরা ভেবেছিলাম, একটা নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে এই স্বাধীনতার ইতিহাসকে তারা সমুন্নত রাখবে। আমাদের তিন জোটের রূপরেখা, সেই ঐতিহাসিক ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, “স্বাধীনতার মূল্যবোধকে আমরা যে কোনো প্রকারেই রক্ষা করব।” কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তব যে, এটাই সত্য যে, আজকে এই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে, এই ৭ই মার্চ পালন করা হচ্ছে না। যে ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, সেই দিন পালন করা হচ্ছে না। এই ব্যাপারে আজকে আমরা এই সংসদে দাঁড়িয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ করছি এই কারণে যে, এই ৭ই মার্চ জাতির পিতা বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ৭ই মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন, “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।” সেই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সামনে রেখে, নয় মাস যুদ্ধ করে যে দেশ আমরা স্বাধীন করেছি, সেই দেশে আজ পতাকা আছে, জাতীয় সংগীত আছে, নেই সেই স্বাধীনতার মূল্যবোধ। আজকে রেডিও-টিভিতে নেই সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যেই ভাষণ আমাদের নয় মাসের যুদ্ধের প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাই আজকে এর তীব্র প্রতিবাদ করছি এই সরকারের কাছে, এই সংসদে দাঁড়িয়ে এখনো আমি অনুরোধ করছি, যাতে আজকে রাতের বেলায় টিভিতে যে অনুষ্ঠান হবে সেই অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ যেন প্রচার করা হয়। দেশবাসীকে জানানো হয়, যাতে নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাসকে জানতে পারে।’ সেদিন জাতীয় সংসদের বক্তৃতায় যে অনুরোধ করেছিলাম বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবুও আমাদের দমাতে পারেনি। গর্বের সঙ্গে বলতে চাই, পৃথিবীর কোনো ভাষণ কোনো দেশে এতবার উচ্চারিত হয়নি। আজ ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। ভাবতে কত ভালো লাগে জাতির জনক নেই, কিন্তু তার ভাষণ শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। যত দিন বাংলার মাটি ও মানুষ থাকবে তত দিন তিনি বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় বিরাজ করবেন।

বঙ্গবন্ধু কোনো দিন লিখিত বক্তৃতা দিতেন না। শুধু জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণটা লিখিত থাকত। যেমন ’৭০-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে লিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ ছিল লিখিত। জাতিসংঘেও লিখিত ভাষণ দিয়েছেন মাতৃভাষা বাংলায়। তবে সেসব ভাষণ তারই ডিক্টেট করা। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল, ‘আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করেন।’ তিনি বলেছিলেন, ‘না, যে ভাষার জন্য আমার ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, সেই ভাষায় বক্তৃতা করে বিশ্বের দরবারে আমার মায়ের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে চাই।’ স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সেই দিনটির কথা। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। আজকে যিনি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা তিনি সে-সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ’৭৪-এ লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সম্মেলনে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিতে এসেছিলেন। সেই আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন। মঞ্চ থেকে নেমে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নিয়েছিলেন। ভাষণ শেষে বিশ্বের বরেণ্য নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কোনো কোনো নেতা এমনও বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের নেতা নন, শেখ মুজিব শুধু এশিয়ার নন, শেখ মুজিব পৃথিবীর নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ নেতা।’ বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তৃতা করেছেন। কানাডায় কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলন, লাহোরে ইসলামী সম্মেলন, আলজেরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন— পৃথিবীর যেখানে গেছেন তিনিই ছিলেন মূলত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কাছে থেকে দেখেছি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা বঙ্গবন্ধুর প্রতি। এমন একজন মহান নেতা যার কোনো তুলনা হয় না। এই বাংলাদেশ তার স্বপ্নের বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশ তার রক্তে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের জন্যই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। এই বাংলাদেশের জন্যই তিনি যৌবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। যিনি জেলখানার সামনে থেকে ’৬৮-তে আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে বন্দী হয়ে মাটি কপালে মুছে বলেছিলেন, ‘এই মাটি আমি তোমাকে ভালোবাসি। যদি আমার মৃত্যু হয়, আমি যেন তোমার কোলে ঠাঁই নিতে পারি।’ পাকিস্তানের কারাগারে জেলের মধ্যে সেল, সেলের সামনে কবরের পাশে দাঁড়িয়েও তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘এই কবরে না, আমার লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার মাটিতে আমি লালিত-পালিত, যে বাংলার আকাশে-বাতাসে বর্ধিত, সেই বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’ সত্যিই তিনি সেই বাংলার মাটিতে শায়িত আছেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। আর কোনো দিন তিনি ফিরে আসবেন না। কিন্তু বাংলার মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন চিরদিন। তাকে মুছে ফেলার সাধ্য কারও নেই। যত দিন বাংলার মাটি আর মানুষ থাকবে তত দিন বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় জাতির জনক চিরদিন অক্ষয় এবং অমর হয়ে থাকবেন।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

 

সূত্রঃ দৈনিক বিডি প্রতিদিন

ছবিঃ সংগৃহীত