৭ মার্চের ভাষণ : স্বাধীনতার চিরঞ্জীব সোপান- হাসানুল হক ইনু
হাজার হাজার বছরের বাঙালিত্বের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের রূপরেখা ও পথনির্দেশ যে চিরঞ্জীব ঐতিহাসিক ভাষণে বিধৃত, সেটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ এর ভাষণ। গত বছরের (২০১৬ সাল) ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো সেই অবিস্মরণীয় ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বপ্রেক্ষিতে এটি এক সুমহান জাতীয় অর্জন। সেইসাথে যারা ইতিহাস বিকৃত করে, ইতিহাস পাথরচাপা দেয়, এই ঐতিহাসিক স্বীকৃতি তাদের গালে সরাসরি চপেটাঘাত।
প্রসঙ্গত: মুজিব আরবি শব্দ। এর অর্থ উত্তর দেয়া, জবাব দেয়া। জাতির ওপর সেই সময় যত অন্যায় হয়েছিল, জাতির যত প্রশ্ন ছিল- সব প্রশ্নের উত্তর দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষণে।
যারা ৭ই মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু এবং পূর্বাপর ঘটনাবলি হিসাবে না-নিয়ে ভাষণের মধ্যে খুঁত ধরার চেষ্টা করেন,তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা-আন্দোলনে অভাবনীয় উঁচুমাত্রার রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়োগ করেন। শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার প্রশ্ন ফয়সালা করেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দিয়েছেন, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আর এই ভাষণ শুধু ভাষণ নয়; পরের দিন ৮ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ রাত পর্যন্ত্ম কী ফলাফল ছিল, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে।
জাতীয় প্রেক্ষাপট
সেইসময় বাঙালির জাতীয় প্রেক্ষাপট কী ছিল ? অতীতে ৪টি বিজয় অর্জন হয়, ’৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচনে বিজয়, ’৬৯-র অভ্যুত্থান, আর ’৭০-র মহানির্বাচনী বিজয়। আবার এই চারটি বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তিনটি মহাষড়যন্ত্র পাকিস্তানিরা করেছিল।, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজানো এবং ’৭০-র নির্বাচনী বিজয় বানচালের জন্য পয়লা মার্চ সংসদ-অধিবেশন বাতিল করে দেয়া। এছাড়া, মাথার ওপর পাকিস্তানিদের পাকিস্তান ভাঙার অভিযোগ ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ ছিল।
চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। গণপরিষদে সংবিধান রচনার উদ্যোগ হয়। কিন্তু মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৫৬ দিন। পাকিস্তানি জান্তার ষড়যন্ত্রে প্রথমে ইস্কান্দর মির্জাকে গভর্ণর করে পাঠানো হয়। পরে আইয়ুব খানের সামরিক হস্তক্ষেপে ’৫৪-র বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়।
ছেষট্টি সালে বঙ্গবন্ধু ছয়দফা দেন। এটি ছিল স্বশাসনের প্রস্তাব। এটি নৎসাত করতে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ৫৪ সালের বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার পর এটি ছিল পাকিস্তানের দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র।
’৬৯ এ গণঅভ্যত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পতন ঘটে এবং আইয়ুব খানের সংবিধানটাও বাতিল হয়ে যায়। এক মাথা এক ভোট নীতিটি প্রতিষ্ঠিত হয়, গণপরিষদে সংবিধান রচনার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সংবিধানটি রচনায় যাতে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার বিধিবদ্ধ থাকে, সেই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচনকে গণরায়ে পরিণত করলেন, গণপরিষদে অর্জন করলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ৬দফার ভিত্তিতে পাকিসত্মানের সরকার গঠন। তাই ’৭০ সালের নির্বাচনটি কোনো গতানুগতিক নির্বাচন ছিল না।
পাাকিসত্মানি কর্তৃপড়্গ দেখল, গণপরিষদে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ৬দফা অন্ত্মর্ভূক্ত করবেন, বাঙালিরা স্বশাসন পাবে। শুধু অভিন্ন প্রতিরড়্গা আর পররাষ্ট্র নীতি ছাড়া পূর্ব বাংলা চলবে নিজের মতো। তারা তা হতে দিতে পারে না। আর এজন্যই গণপরিষদে অধিবেশন ১লা মার্চ বসার কথা থাকলেও ইয়াহিয়া খান তা নাকোচ করে দেন।
বঙ্গবন্ধুর এ উদ্দেশ্য যাতে সফল না হয়, সেজন্যই ইয়াহিয়া খান পহেলা মার্চে গণপরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করে। এভাবেই আবার ছিনতাই হয়ে যায় বাঙালির গণরায়। তখন সারাদেশে বিড়্গোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২রা মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলা পতাকা। ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন মযদানে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। সুতরাং ৭ই মার্চ তিনি যখন মঞ্চে দাঁড়ালেন, তখন স্বাধীন বাংলার পতাকা এসে গেছে, জাতীয় সংগীত এসে গেছে, এসে গেছে স্বাধীনতার ইশতেহারও।
৮ই মার্চ থেকে তিনি অসহযোগ ডাক দিলেন। এই অসহযোগ গান্ধীর অসহযোগ নয়, দেশের কর্তৃত্বই নিয়ে নিলেন। অসহযোগ পাকিসত্মানের সাথে, আর দেশ পরিচালনার জন্য নিলেন কর্তৃত্বভার। কিভাবে অফিস, আদালত, ব্যাংক চলবে, আইন-শৃঙ্খলা রড়্গাকারিবাহিনী কিভাবে কাজ করবে, জনগণ কি করবে-সকল নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। পূর্ব বাংলার রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই পাকিসত্মানি নির্দেশ অমান্য করে বঙ্গবন্ধুর জারিকৃত ফরমান অনুযায়ী চলা শুরম্ন করে।
ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু দু’টো সংগ্রামের কথা বলে বাঙ্গালি জাতিকে নিয়ে তার দর্শন তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ ভৌগলিক স্বাধীনতার সাথে তিনি শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত হবার সংগ্রামের কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষ ও সমাজের মুক্তির কথা বললেন তিনি।
২৫ মার্চের রাতে বাংলাদেশ আক্রমণ ছিল পাকিসত্মানের চার নম্বর চক্রান্ত্ম। বঙ্গবন্ধু এই চক্রান্ত্ম পূর্বেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেছেন এর আগে ’৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালিদের বিজয় কিভাবে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, ’৬৬ সালে তাকে মিথ্যা মামলায় হত্যার চক্রান্ত্ম করা হয়েছে আর ’৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েও বাঙালিদের গণপরিষদে বসতে দেয়া হচ্ছে না। অতীতের তিন চক্রান্ত্মের জালে বাঙালিদের আটকে রাখলেও আর কোনো চক্রান্ত্মে যাতে পাকিসত্মানিরা বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে না পারে, সেজন্যই ৭ই মার্চ মঞ্চে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালিরা যাতে সরাসরি চক্রান্ত্ম বানচাল করে স্বপ্নের স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে, তার ভাষণে সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পথই দেখালেন তিনি। আর পিছু ফেরা নয়, আর বঞ্চনা নয়, নয় শোষণ আর লাঞ্ছনা, এবার স্বাধীনতা, এবার মুক্তি।
আন্ত্মর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেড়্গাপট
এই ভাষণ দেবার সময় আন্ত্মর্জাতিক ও আঞ্চলিক কী পরিস্থিতি ছিল, তা-ও লড়্গ্য করার বিষয়। মনে রাখতে হবে সেই সময় ’৬৫-র পাক ভারত যুদ্ধের পরে তাসখন্দ শান্ত্মিচুক্তি হয়েছিল। পাকিসত্মান-ভারত-রাশিয়া শান্ত্মির বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। অর্থাৎ ভারতের সাথে তখন পাকিসত্মানের শান্ত্মি। বাংলাদেশের পড়্গ নিয়ে ভারত যুদ্ধে লিপ্ত হবে- তা বলার কোনো আগাম অবকাশ ছিলোনা।
তাছাড়া, পাকিসত্মানিদের সঙ্গে কমনওয়েলথ দেশভুক্ত এবং কমনওয়েলথ বহির্ভূত ইউরোপের সকল দেশের সুসম্পর্ক ছিল এবং মার্কিন ও চীন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। অপরদিকে ’৬৫-র যুদ্ধের পরে ভারত এবং চীনের বিরোধ ছিল, ভারত এবং রাশিয়ার কোনো চুক্তি ছিল না। আর সেই সময়টা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার শীতল যুদ্ধের সময়।
স্বাধীনতার ঘোষণা
চতুর্থ চক্রান্ত্মের পরেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়, যুদ্ধ হলো দু’টি স্বাধীন দেশের মধ্যে। তার আগে ৮ই মার্চ থেকেই তিনি শাসনভার নিজের হাতে নিয়েছেন। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। মানুষের মধ্যে তৈরি করেন অবিচল আস্থা আর বিশ্বাস। যার ফলে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হলেও তখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালিই মুজিব হয়ে গেছে। ১৭ এপ্রিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকার গঠিত হলো। পৃথিবীর দেশসমূহ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শুরম্ন করলো। ১৯ তারিখ থেকে সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যরা পাকিসত্মানের পড়্গ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পড়্গে অবস্থান নেন। বিচ্ছিন্নতাবাদের কোনো অপবাদ বাঙালিদের ওপর আসেনি। বঙ্গবন্ধু তার গভীর প্রজ্ঞা আর কৌশলে সেই অবস্থান তৈরি করেছেন। বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম পাকিসত্মান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আন্দোলন নয়, একটি মুক্তিকামী জাতির স্বাধিকার, স্বশাসনের আন্দোলন। এ কারণেই ২৫ মার্চ পাকিসত্মানিদের আক্রমন স্বশাসিত বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ আর ২৬ মার্চ থেকে পাকিসত্মান ও বাংলাদেশ, দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ।
বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে তিল তিল করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নাগরিককে স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ’৬৬-তে ৬ দফা উত্থাপন এবং স্ব-শাসনের পক্ষে গণরায় অর্জন ’৭০-এ। এছাড়া, ’৬৯-র গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুবের শাসনতন্ত্র বাতিল, একমাথা একভোট অর্জন করে তিনি গণপরিষদের ভোট আদায় করে নেন এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
প্রধানমন্ত্রী হবেন, না কি স্বাধীনতার লক্ষ্যে উত্থিত জাতির কর্তৃত্বভার প্রকাশ্যে গ্রহণ করবেন-এই প্রশ্ন ছিল তাঁর সামনে। তিনি উত্তর দিয়েছেন শান্ত্ম অথচ বজ কণ্ঠে- ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’ আর সেকারণেই এই ভাষণের আগেই তাঁর নির্দেশনায় স্বাধীনতার পতাকা উঠেছে, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছে, জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে দেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়েছে, জয়বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়েছে, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ চালু হয়েছে।
৭ মার্চ: ইতিহাস বদলে দেবার সিদ্ধান্ত্ম
এমনই এক পরিস্থিতিতে ইতিহাস বদলে দেবার সিদ্ধান্ত্ম নিয়ে মঞ্চে দাাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। শান্ত্মিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার লক্ষ্যে রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়োগ করেন এই ভাষণে। মঞ্চে যখন বঙ্গবন্ধু ওঠেন, ঠিক তখনকার অবস্থা কী ছিল? বিশাল জনসমুদ্র সামনে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠে জয়বাংলা ধ্বনি, চোখে মুক্তির আগুন। একদিকে পাকিসত্মানি সেনাকর্তৃপক্ষের রক্তচড়্গু, আরেকদিকে স্বাধীনতা শব্দটা ধ্বনিত হচ্ছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার মন্ত্রে জাতিকে এগিয়ে নিতে সেই ভাষণের মধ্য দিয়েই অসহযোগের নামে ৮ই মার্চ সকাল থেকে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেন। প্রায় ৩০টির ওপর ফরমান দিয়ে দেশ পরিচালনা শুরম্ন করেন। ২৩ মে মার্চ সারাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওঠানো হয়, শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়া হয় পাকিসত্মানের কফিনে ।
কার্যত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীন শাসন শুরম্ন হয় এবং এই স্বাধীন শাসনকে যেন কোনোভাবেই বানচাল করতে না পারে তার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের দিকনির্দেশনাও তিনি পরিস্কারভাবে ভাষণে দেন। আমরা দেখি পাকিসত্মানিদের চতুর্থ ষড়যন্ত্র। ২৫শে মার্চের রাত্রে স্বাধীন স্বশাসিত বাংলাদেশের উপর আক্রমণ। বঙ্গবন্ধু কালবিলম্ব না করে ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে স্বাধীন বাংলার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরম্ন করে দেন। সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠালাভ করে।
৭ মার্চ ভাষণের দশ অধ্যায়
এখন পূর্বাপর এই ঘটনার প্রেড়্গিতে ভাষণটি যদি মিলিয়ে দেখি, তাহলে দেখা যায় কী নিখুঁতভাবে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ সাজিয়েছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে দশটি অধ্যায় চিহ্নিত করা যায়-
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ -২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা ও বাঙালির অধিকার অস্বীকারের ইতিহাস
১৯৭০ এর নির্বাচনের গণরায় বানচালে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র
(৩) পাকিস্তানের নয়া চক্রান্ত- ১০ মার্চের গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
(৪) বঙ্গবন্ধুর পাল্টা প্রস্তাব-সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরৎ যাওয়া, হত্যার তদন্ত, জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
(৫) সর্বাত্মক অসহযোগ- হরতালের ঘোষণা
(৬) প্রয়োজনে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক
(৭) পূর্ববাংলা পরিচালনার রাজনৈতিক কর্তৃত্বভার গ্রহণ
(৮) পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থ চালান বন্ধ ও পশ্চিম পাকিসত্মানের সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন করা
(৯) সশস্ত্র প্রতিরোধের আহ্বান ও জাতীয় মুক্তি- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ এবং
(১০) মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘোষণা।
সুতরাং এই ভাষণের ফলাফলে পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে, কী অপূর্বভাবে তিনি স্বশাসন এবং স্বাধীনতা, গণ-আন্দোলন, নির্বাচন ও সশস্ত্র সংগ্রামের সমন্বয় সাধন করেছেন। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতা পেতে কিভাবে দাঁড় করিয়ে দিল, পৃথিবীর ইতিহাসে সেই অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের জন্যই ইউনেস্কোর এই যুগান্ত্মকারী স্বীকৃতি।
এই অর্জন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ’৭৫-এর পর সামরিক কর্তৃপড়্গ জাতির ইতিহাস কেড়ে নেয়। কেড়ে নেয় অর্জনগুলো। ইতিহাস ও অর্জনগুলো পুনরম্নদ্ধারের জন্য আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে লড়াই শুরম্ন করেছি, সেই পর্বে ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে আজকে আমরা আলোচনা করছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এবার বাংলাদেশের পথে চলতে শুরম্ন করেছে। বাংলাদেশের রক্তাক্ত আত্মা আবার ফিরে এসেছে শেখ হাসিনার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর স্বমহিমায়, স্বসম্মানে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন।
যে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, সেই বাংলায় আবার রাজাকার-জঙ্গি-ছোবল মারছে। এটা চলতে দেয়া যায় না। শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ বাংলাদেশের পথে চলতে শুরম্ন করেছে। সেই নেত্রীর নেতৃত্বে যে মহাঐক্য গড়ে উঠেছে, যার সেনাপতিত্বে আমরা যে লড়াই চালচ্ছি তা জঙ্গি-রাজাকারমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বঙ্গবন্ধু দেশ উপহার দিয়েছেন। শেখ হাসিনা আবার শান্ত্মির দেশ গড়ে দেবেন।
চলিস্নশের দশকে মনিষী এম, ওয়াজেদ আলী আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে বলেছিলেন, “এই জাতি একজন মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে।” ৭ মার্চ ১৯৭১ আমাদের সেই প্রতীক্ষা শেষ হলো, মহামানব বঙ্গবন্ধুকে পেলাম। সকল অর্থেই তিনি সেই মহামানব যে বাংলাদেশকে ১৭৫৭ এর পলাশী থেকে ২১৪ বছর পর ১৯৭১ এ স্বাধীন করলেন।
বাবলু জোয়ার্দারের ভাষায়-
“সে ছিল দীঘল পুরুষ-
হাত বাড়ালেই ধরে ফেলতো
পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইল,
সাড়ে সাত কোটি হৃদয়,
ধরে ফেলতো বৈশাখী মেঘ অনায়াসে।”
আর এ অজস্র কারণেই ৭ই মার্চের বজ কণ্ঠের বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন-একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ, বাঙালি জাতীয়তার একটি মহাকাব্য, একটি আন্দোলন, জাতি নির্মাণের কারিগর, ঠিকানা প্রদানের সংগ্রাম, একটি বিপস্নব, একটি অভ্যূত্থান, একটি ইতিহাস, বাঙালি জাতির ধ্রম্নবতারা: জাতির উত্থান, রাজনীতির কবি, জনগণের বন্ধু, রাষ্ট্রের স্থপতি, স্বাধীনতার প্রতীক, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অমর পিতা।
জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবি হোক।
সূত্রঃ দৈনিক বিডি প্রতিদিন
ছবিঃ সংগৃহীত