নির্বাচনী বাজেটে কর নয়, থাকবে ছাড়
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠক উপলক্ষে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। গত ২২ এপ্রিল ওয়াশিংটন ডিসিতে হোটেল স্যুটে তিনি সাক্ষাৎকার দেন সমকালকে। এতে আগামী বাজেট, জাতীয় নির্বাচনসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে
বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরের বাজেট সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, যাতে করে ভোটারদের মাঝে বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিষয়টি মাথায় রেখে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নতুন বাজেট সাজাতে শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বৈঠক করার পর বাজেট চূড়ান্ত করবেন বলে জানান তিনি।
মুহিত নিজেও স্বীকার করেছেন, নানা কারণে নতুন বাজেট তার কাছে এবার অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটি হবে তার জীবনের
শেষ বাজেট। নির্বাচন মাথায় রেখেই বাজেট করতে হবে। সঙ্গত কারণে বাজেট অন্যবারের মতো হবে না। এতে অনেক ছাড় দেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটে নতুন কোনো করারোপ করা হবে না। এটিই হবে নতুন চমক। রাজনৈতিক কারণে অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আগামী ৭ জুন জাতীয় সংসদে বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে শেষ বাজেট ঘোষণা করবেন তিনি। এ নিয়ে টানা দশমবারের মতো বাজেট দিতে যাচ্ছেন মুহিত। এর আগে এরশাদ সরকারের আমলে দুটি বাজেট দেন তিনি। মুহিত বলেন, আগে থেকেই জানি প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে ছয় মাস সময় পাব। তারপর নতুন সরকার বাকি অর্ধেক সময় বাস্তবায়ন করবে। ফলে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, এই বাজেট থেকে উপকৃত হবে জনগণ। তার দৃঢ় বিশ্বাস, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগই ফের ক্ষমতায় আসবে।
প্রাক-বাজেট আলোচনায় বিভিন্ন সময়ে নতুন বাজেটের আকার ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ অবস্থান থেকে সরে এসেছেন এখন। মুহিত জানান, তিনি ঠিক করেছেন, আগামী বাজেটের আকার অত বড় হবে না। এর আকার চার লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে থাকবে। তবে বাজেট ঘাটতি পাঁচ শতাংশই বহাল থাকবে। তার প্রত্যাশা, রাজস্ব আদায় আগামীতে আরও বাড়বে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, রাজস্ববান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে- এখনকার তরুণ সমাজ খুবই সচেতন। কর প্রদানে আগ্রহী তারা। এটা খুবই আশার কথা। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সম্পর্কে অনেক সচেতন হয়েছেন তারা। সাগ্রহে কর দিতে এগিয়ে আসছেন তরুণরা। এসব কারণে রাজস্ব আদায় আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
নির্বাচনের বছরে সাধারণত সব দেশের অর্থমন্ত্রীরাই জনতুষ্টির বাজেট দিয়ে থাকেন। আগামী বাজেটে এ ধরনের পদক্ষেপ থাকবে কি-না? জবাবে মুহিত বলেন, আমি সব সময়ই নতুন কিছু করার চেষ্টা করি। আগামী বাজেটেও তেমন কিছু থাকবে। এবারও একটা উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন বলতে পারব না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে নতুন কর আরোপ করা হবে না। দুই বছরের জন্য নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে মূল্য সংযোজন করে (ভ্যাট) কিছু করার সুযোগ নেই।
প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেন, করপোরেট কর কাঠামো যৌক্তিক করতে চান। বর্তমানে বিভিন্ন হারে করপোরেট কর ধার্য আছে। দেশে করপোরেট করহার বেশি। ফলে কিছু ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমানো হবে। একই সঙ্গে করপোরেট করের একাধিক হারের পরিবর্তে দুটি বা তিনটি স্তর নির্ধারণ করে আরও সহজ করার চিন্তাভাবনা চলছে। করপোরেট করহার কমানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে মুহিত বলেন, মানুষ যখন আগ্রহী হয়ে কর দিচ্ছে তখন আমি যদি কমিয়ে দেই তাহলে আদায় কমবে না, বরং বাড়বে। তখন কর দিতে উৎসাহিত হবেন সবাই। তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে চূড়ান্ত করতে হবে। তিনি বলেন, এরমধ্যে বাজেটে কিছু পরিবর্তনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। কী কারণে পরিবর্তনটা প্রয়োজন সেটা তাকে জানানো হয়েছে। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এগুলো চূড়ান্ত করা হবে।
প্রশ্নোত্তরে তিনি জানান, ব্যক্তি করহারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তার মতে, প্রতি বছর ছাড় দেওয়া উচিত নয়। বিভিন্ন দেশে ব্যক্তি খাতের করমুক্ত আয়ের সীমা স্থির থাকে। আমরা বছর বছর পরিবর্তন করছি। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা এখন যা আছে তাই বহাল থাকবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি।
তিনি জানান, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হবেই। এতদিন একটি হারের পক্ষে থাকলেও এখন দুটি হারের নির্ধারণের কথা উল্লেখ করেন তিনি। বর্তমানে ভ্যাটের একাধিক হার রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মুহিত জানান, এতগুলো রেটের পরিবর্তে একটি বা অভিন্ন রেট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি দুটি রেট করার পক্ষে।
শেষ বাজেটটি কেমন হবে? জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'এটা নির্বাচনের বছর, অনেক বিধিনিষেধ আছে। দেখা যায়, আমার পছন্দ নয়, তারপরও নির্বাচনের স্বার্থে অনেক জায়গায় ছাড় দিতে হবে। এর চেয়ে বেশি এখন কিছু বলতে পারব না।'
নির্বাচন সামনে রেখে এমপিরা বাজেটে বেশি বরাদ্দ চাচ্ছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুহিত বলেন, না এটি ঠিক নয়। তাদের (এমপি) যা দেওয়া আছে, তা খরচ করতে পারেন না। বেশি বরাদ্দ দিয়ে লাভ কী? নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও (সরকারি বেতনের অংশ) দেওয়া হবে কি-না- এ প্রশ্নের জবাবে বলেন. 'এতদিন দেওয়া হয়নি, এবার দেব। তবে দেখেশুনে এমপিও অনুমোদন দেওয়া হবে।'
প্রশ্নোত্তরে অর্থমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন না জানিয়ে বলেন, আমার ভাই মোমেন নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছে। নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে মোমেন। সে ভালো কাজ করছে। আমি দাঁড়াব না। প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ করলে কী করবেন? জবাবে বলেন, সেটা তো আলাদা কথা। প্রধানমন্ত্রী বললে সেটা পার্টির হুকুম হয়ে যায়- মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।
আপনি অনেক বাজেট দিয়েছেন। সফল একজন অর্থমন্ত্রীও। আপনার কোনো দুঃখ আছে কি-না- উত্তরে মুহিত বলেন, সে তো অনেক কিছু আছে। যেমন- করপোরেট কর কাঠামো যৌক্তিকীকরণের বিষয়টি বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও করতে পারিনি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার আরও কমাতে চেয়েছিলাম, পারিনি। এরকম আরও অনেক কিছু আছে, করা সম্ভব হয়নি। তবে এ জন্য দুঃখ নেই।
আগামী দিনে বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান? মুহিত বলেন, খুব শিগগির একটা উন্নত দেশ হবে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। আমি আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের আগেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে। বাংলাদেশ শিল্পসমৃদ্ধ দেশ হবে। শিল্পের প্রসার দারুণভাবে হচ্ছে। এখন যেটা দরকার তা হলো- বড় ধরনের ম্যানুফ্যাকচারিং (উৎপাদনমুখী) শিল্প স্থাপন করতে হবে। সময় অনুকূলে রয়েছে। বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হচ্ছেন। আশা করছি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বড় আকারে শিল্প গড়ে উঠবে।
আপনার জীবনে সব আশা কী পূরণ হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, হ্যাঁ, একেবারে পরিপূর্ণ তৃপ্ত। মহাতৃপ্তিতে আছি। বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। এর চেয়ে বড় সন্তুষ্টি আর কী হতে পারে- মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।
সূত্রঃ দৈনিক সমকাল
ছবিঃ সংগৃহীত